Rose Good Luck পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-১০) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৭:২৭:১২ সন্ধ্যা



আমার বাবু!

আমি স্কুলে ক্লাশ নাইনে ক্লাসে ফার্স্ট বয় ছিলাম। এখনকার মত স্কুলের টীচাররা এত বেশি প্রাইভেট পড়াতেন না। প্রাইভেট টিউটররা বেশিরভাগই হতেন ভার্সিটির স্টুডেন্ট বা ব্যাংকার। সেই সময়ে ও আমাদের স্কুলের দুই একজন স্যার প্রাইভেট পড়াতেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসের সংঘাত বা প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে শিক্ষকদের কারো কারো মধ্যে ইর্ষা, রেষারেষি ছিল, তবে এখনকার মত না। সে সব আমরা খুব কমই জানতে পারতাম। তবে উনারা উনাদের বিশ্বাসের ব্যাপারে আমাদেরকে বলতেন। আমাদের স্কুলে শিক্ষদের ভিতরে ও এখনকার মত ভিন্ন মতাদর্শে ভিন্নতা ছিল। আমাদের কয়েকজন আওয়ামী পন্থী, বি এন পি পন্থী শিক্ষক সক্রিয়ই ছিলেন। কিন্তু ছাত্রদেরকে বাজে ভাবে রাজনীতিতে ব্যবহার ও করতেন না, নোংরামিতে ও লিপ্ত ছিলেন না।

হেড স্যার জামায়াতে ইসলামির উচ্চ পর্যায়ের সদস্য ছিলেন। আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন জিন্নাহ স্যার। তিনি ছিলেন কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত। খুলনার কমরেড রতন সেনের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। স্যারের খুব প্রিয় পাত্র ছিলাম আমি। স্যার আবার পুর্ব বাংলা কম্যুনিস্ট পার্টির একজন তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন। তিনি শুধু আদর্শের প্রচারের কাজেই তার লিখালিখি দ্বারা ব্যস্ত থাকতেন। আর আমাদেরকে স্বপ্নের কথা শোনাতেন। একটি শোষণ মুক্ত সমাজের কথা, সর্বস্তরে সাম্যের কথা এগুলো দ্বারা আমরা অনেক প্রভাবিত হয়েছিলাম।স্কুলের উপরের ক্লাসের কিছু ছেলের ও রাজনীতি বিষয়ে মতামত, সমর্থন, বিরোধিতা ছিল। অনেক সময় কোন কোন শিক্ষকের বিশ্বাস অবিশ্বাস কিছু ছেলেকে বেশ অর্গানাইজড করে ফেলত। এরশাদ সামরিক শাসন জারী করার পরে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অভিভাবকরা স্বস্তি বোধ করেন। নিজেরদের স্বাধীন মত প্রকাশ আর সেই মতের পক্ষে কাজ করার আগ্রহ যাদের ছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের পথ ছাড়তে পারলেন না। কিন্তু সার্বিকভাবে এই সময়টায় সামরিক শাসন একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরী করে। কখনো কখনো তা অবিচারে অত্যাচারে রূপ নিত। আমরা দেখেছি লম্বা বাবরি চুলের যুবকদেরকে আর্মির পারসোনেলরা প্রকাশ্যে চুল কেটে দিয়েছে, দুই তিনজন উঠতি ছেলে এক জায়গায় জড়ো হলেই আর্মি এসে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। একদিন সন্ধ্যার পর আমাদের পাশের গলি থেকে একজন বড় ভাইকে তাদের ঘরের সামনের রাস্তায় মোটর বাইকের উপর বসা অবস্থা থেকে নিয়ে গিয়ে আর্মি সারা রাত এমন অত্যাচার করল, তাকে সকালে গিয়ে ছাড়িয়ে আনার পর চেনা যাচ্ছিল না। অনেক সরকারি অফিসারেরা দূর্নীতির বিরুদ্ধে এরশাদের 'স্বচ্ছ করার অভিযান' দেখে ভয়ে চাকুরী ছেড়ে দিয়েছেন। সবাই মনে করেছিল একটা নতুন কিছু করার ব্রত নিয়েই এই মানুষটি এসেছেন। কিন্তু লৌহযবনিকার অন্তরালের এই মানুষটি কিভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তার এভাবে প্রকাশ্যে আসার পেছনের উদ্দেশ্যটি কি তা নিয়ে ইতিবাচক নেতিবাচক নানান কথা নানান মত ঘরে ঘরে ড্রইং রুমে, খাওয়ার টেবিলে বা শোবার ঘরে ঠিকই চর্চা হতো। ছাত্র রাজনীতির বড় অংশ এভাবে ঘরোয়া রাজনীতিতে রূপান্তরিত হল। দেশ অন্য দেশের হাতে না গিয়ে এখনো দেশের লোকের হাতে আছে ভেবেই হোক, আদার ব্যাপারি জাহাজ চালাতে পারবে না ভেবেই হোক, সাধারণ মানুষ আস্তে আস্তে হাপ ছেড়ে কিছুটা হালকা মেজাজে রইল। কিন্তু চাপ আস্তে আস্তে বাড়ছিল।

রাজনীতিবিদেরা তখন কী ভাবছিলেন? সামরিক সরকার বিষয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলো সামরিক শাসন দেশে নিজেদের ভিতর লড়তে থাকা অনেক দল মত পথের তৈরী বিশৃংখলা, কোন্দলকে শাসন করতে পারে ঠিকই, অনেক দুর্নীতিকে, দুষনকে দমন, সংশোধন করতে পারে ঠিকই, কেন যেন নিজেদেরকে ক্ষমতার ব্যবহারটাকেই শেষ পর্যন্ত সীমার ভিতর রাখতে পারে না।

আমার জীবনের গতি প্রকৃতি আমূল বদলে দিয়েছিল দুটি পরিবার। একটি পরিবার তিন ভাইয়ের তিনটি বিশাল পরিবার। সৈয়দ পরিবার। তিন ভাইয়ের ভিতরে দুই ভাই মারা গেছেন। এক ভাই জীবিত। অন্য দুই ভাইয়ের ছেলেরা ঐ জীবিত চাচার সাথে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছিল। এই পরিবারটির সাথে আত্মীয়তার সূত্রে আরো একটি পরিবার ছিল যারা সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট এরশাদের মন্ত্রী হবার সুবাদে খুবই ভয়ংকর ছিল। ঐ মন্ত্রী পরিবারটির এক সদস্য পরবর্তীতে একজন বিখ্যাত সাংবাদিক মার্ডারের দ্বারা দেশে বেশ আলোচিত হয়েছিল। এই সৈয়দ পরিবারের ভিতরেও সব দলের মিশ্রনে এক রাজনৈতিক ইন্সটিটিউশন বিরাজ করছিল। জামাত, জাপা, বিএনপি ও আওয়ামীলীগের সমর্থন নিয়ে এরা কয়েক যুগ ব্যাপী রাজত্ব করে আসছিল ঐ এলাকায়। এরা ছিলো এক পক্ষ। এদের কাউন্টার ছিল আর এক পক্ষ। সেই পরিবারটি ১৯৭১ এ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। এদের বড় ছেলে খুলনার এক সরকারী অফিসের নিলামকে কেন্দ্র করে ঐ সৈয়দ বাড়ির ছেলেদের হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়। কিন্তু ক্ষমতা আর অর্থের জোরে এবং উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক কানেকশনের জন্য খুনীদের কিছুই হল না। তারা আরো বেপরোয়া হয়ে শহরের রাস্তায় খোলা জীপ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলো। যাদের ছেলে মারা গেলো তার বাবার নাম ছিল রুস্তম শেখ। রুস্তম শেখ এর পরিবারে রুস্তমের ছিল চার ছেলে। বাকী তিন ছেলে বড় ভাইয়ের লাশ ছুঁয়ে প্রতিশোধ নেবার শপথ নিয়েছিল। ঘটনাটি একেবারে সিনেম্যাটিক হলেও বাস্তব ছিল। এভাবে ওই দুই পরিবারের ভিতরে শত্রুতা গড়ে উঠল।

শেখ পরিবারের সাথে আমার কিভাবে যেন সখ্যতা গড়ে উঠল। সেটা ওরা নির্যাতিত এবং ঐ সৈয়দদের থেকে অর্থ বিত্তে ছোট বলেই কি? নাকি মনের ভিতরে এক সতত নির্যাতিতদের জন্য অকৃত্রিম দরদ বয়ে যাচ্ছিল বলে? আর আমরা এই দুই পরিবারের বিষবলয়ের ভিতরে অবস্থিত এলাকায় যায়গা কিনে বাড়ি করাতে না চাইতেও এদের সাথে মিশে গেলাম। সৈয়দদের ছেলেরা শীতের সময়ে পাখি শিকার করে আমাদের বাড়িতে এসে দিয়ে যেতো হুড খোলা জীপে করে। আব্বার সাথে ঐ পরিবারের ছেলেদের বেশ আন্তরিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। আমি বহুদিন দেখেছি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, ওরা আব্বাকে চাচা ডাকতো। আব্বাকে সদর দরোজায় দাঁড়িয়ে ওরা অতিথি পাখিগুলো ( পাখি হলেও অতিথি। অতিথি মারা ঠিক না) আদবের সাথে বুঝিয়ে দিচ্ছে। তবে ওরা কখনোই আমাদের বাড়ির ভিতরে আসত না। বাবা তখন নিজের থেকে অনেক দূরে সরে গেছিলেন, যাচ্ছিলেন সেটা ঐ বয়সেই আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কেন সেটাকে না বুঝতে পেরে ক্রমশঃ হৃদয়ের ভিতপরে এক দন্দ্ব তৈরী হচ্ছিল বাবার সাথে । তবে আজ বুঝি তিনি আমাদের সুখী সুন্দর ভবিষ্যত তৈরী করতে নিরাপদে রাখতেই ওদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে চেয়েছিলেন। আর নিজের চাকুরির সাথেও ঐ পরিবারটির কেমন যেন লিংক ছিল।

তবে আমার ভিতরে জিন্নাহ স্যারের স্বপ্ন। শ্রেনী সংগ্রাম, মার্ক্স-এঙ্গেলস ততোদিনে ধীরে ধীরে বীজ থেকে অংকুর, অংকুর থেকে চারা গাছে পরিণত হয়ে গেছে। আমি আমার বাবাকে ঐ শোষক শ্রেণীর একটা অংশ হিসেবে দেখতে পেলাম, অবাক হলাম, ভিতরে ভিতরে মরে যেতে থাকলাম। তিনি যদিও সরাসরি শোষক ছিলেন না, তবু তার নিজ যায়গায় দূর্নীতির একটি স্তম্ভ হয়ে উঠেছিলেন ততোদিনে। তিনি ঐ ধনিক শ্রেনীর চিন্তা-ভাবনায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে ফেলেছিলেন। আর আমি ছিলাম স্কুলের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আমরা বাবা-ছেলে দুজনের ভিতরের দ্বন্দ্ব , এলাকার দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব - সবকিছুর দর্শক শ্রোতা। সব জায়গায় জীবন আমার সামনে এক কঠিন নাটকের মঞ্চায়ন করছিল। এলাকার কথাই বলি। ওখানে আমাদের এবং অন্য বসবাসকারী সাধারণ মানুষের ভূমিকা ছিল আসলে অনেকটা নিষ্ক্রিয় দর্শকের। তবে চিরকালের নিয়ম, নির্যাতিতেরা এক সময় নির্যাতনকারীকে নির্যাতন ফেরত দিতে শিখে ফেলে। রুস্তমের ছেলেদের ভিতরে ততোদিনে মেঝ ছেলে নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি গ্রুপের একটি অংশে যোগ দিয়েছে।

এরই মাঝে আমি ক্লাশ নাইনে উঠতেই আমাদের পরিবারে একজন সদস্য বাড়ে। আমার ছোট বোন জন্ম নেয়। আমরা তাকে নানান নামে ডাকতে থাকলাম। এক রকম প্রতিযোগিতা ছিল, কার দেয়া নামটা থাকে। বাদলকে রাজী করিয়ে আমার দেয়া নামটা আমরা দুই ভাই ডাকতে থাকলাম।

আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম, বোন হলে তাকে ডাকনাম দেবো ' চাঁপা'। চাঁপার গায়ের রংটা খুব ফর্সা ছিল। সে সবার খুব আদরের হলো। অনেক দিনের মনমরা ঘরে আনন্দের ছোঁয়া লাগল। Rose Good Luck

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

৭৮৪ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

290302
০১ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৫
সন্ধাতারা লিখেছেন : Chalam. Very beautiful writing. Jajakallahu khair.
০২ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৫৯
234145
মামুন লিখেছেন : আসসায়ালামু আলাইকুম আপু।
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
বারাকাল্লাহু ফিকুম।Good Luck Good Luck
290306
০১ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫৫
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০২ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৫৯
234146
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।Good Luck Good Luck
290379
০২ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১২:৪৮
সালসাবীল_২৫০০ লিখেছেন : চমৎকার হয়েছে! ধন্যবাদ
০২ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৮:০০
234147
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকেও।Good Luck Good Luck
290391
০২ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৪১
নাছির আলী লিখেছেন : অসাধারন হয়েছে।াওনেক অনেক ধন্যবাদ, যাযাকাল্লাহ
০২ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৮:০০
234148
মামুন লিখেছেন : ভালো লাগা রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।Good Luck Good Luck
290415
০২ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৪:৩৪
কাহাফ লিখেছেন :
সামরিক সরকার দেশের ভেতরকার বিশৃংখলা-দূর্ণীতি-দূষণ ইত্যাদি দমন-সংশোধনে অধিক কার্য্যকর! একসময় ক্ষমতা কে সীমার ভীতর রাখতে যদিও পারে না!
তবুও বর্তমান সময়কাল বিবেচনায় আগেকার সামরিক শাসন অনেক ভাল মনে হয়!
বরাবরের মতই মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেল উপস্হাপনা!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইরান। Rose Rose Rose
০২ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৮:০১
234149
মামুন লিখেছেন : সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।Good Luck Good Luck
290623
০২ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৩
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : ভালোই লাগছে লেখাতে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, এমন কি দেশের জনগণের অধিকারের কথাও উঠে এসেছে। এক সাথে অনেক কিছু জানতে পারছি।
যাযাকুমুল্লাহ খাইরান আপনাকে।
০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৮:০১
234466
মামুন লিখেছেন : ভালোলাগার অনুভূতি জানেই গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
বারাকাল্লাহু ফিকুম।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File